https://tipswali.com/wp-content/uploads/2021/11/black-friday-in-Bengali.jpg

পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আমরা বিশেষ করে বর্তমান সময়ের যুবক যুবতীরা দিন দিন অনেকটা নিজের করে নিয়েছে। বিসর্জন দিয়েছে নিজের সংস্কৃতি। অবশ্য তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে অন্য দেশের বা গোত্রের আচার, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা ও অন্যকে নিজের সংস্কৃতি জানানো যতোটা সহজ আগের দিনে তা ছিলো না। এইতো কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের মানুষ ব্ল্যাক ফ্রাইডে শব্দটিও শুনে নি। গ্রামের বা শহরের একটু বয়স্ক লোকদের কাছে জিজ্ঞাস করে দেখতে পারেন আমার মনে হয় হাতেগোনা দুই-চার জন বাদে বেশিরভাগই এই ব্ল্যাক ফ্রাইডে সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে না।

আসলে আমিও স্কুলে পড়াকালীন সময় পর্যন্ত এ সম্পর্কে জানতাম না। যতদূর মনে পড়ে ফেসবুকে কোন একটি পোস্টে প্রথম ব্ল্যাক ফ্রাইডে সম্পর্কে জেনেছিলাম। এই লেখাটি যিনি পড়ছেন আমার মনে হয় আপনারও হয়তো টিভি কিংবা অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে ব্ল্যাক ফ্রাইডে সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে আর তাই আপনি গুগলে এ সম্পর্কে জানতে চেয়ে সার্চ করেছেন।

সম্মানিত ভিজিটর, আজকের লেখাজুড়ে আমি আপনাদের সাথে বিস্তারিত শেয়ার করতে যাচ্ছি ব্ল্যাক ফ্রাইডে কি? ব্ল্যাক ফ্রাইডের ইতিহাস, ও এর সাথে সম্পৃক্ত ঘটনাবলি, কেনাকাটার প্রস্তুতি, আপনার কি এ দিনটি উদযাপন করা উচিত নাকি উচিত না।

ব্ল্যাক ফ্রাইডে কি?

আমেরিকা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থ্যাঙ্কস গিভিং ডে এর পরের শুক্রবার অর্থাৎ নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবারের পরের দিনকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলা হয়। এই দিনে আমেরিকান ব্যবসায়ীরা পন্যের বেচাকেনা বাড়াতে ও প্রচারের জন্য তাদের পন্যে বিশাল মূল্যছাড় দেয়।

এক লাইনে বলতে গেলে, থ্যাঙ্কস গিভিং ডে এর পরের শুক্রবারকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে বলা হয়।

ব্ল্যাক ফ্রাইডের ইতিহাস

আক্ষরিক অর্থে ব্ল্যাক অর্থ কালো আর ফ্রাইডের অর্থ শুক্রবার হলেও ব্ল্যাক ফ্রাইডের ইতিহাস একটু আলাদা। যারা ইতিমধ্যে ব্ল্যাক ফ্রাইডের ইতিহাস জানেন না তাদের কাছে বিষয়টি একটু ইন্টারেস্টিং লাগবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক-

সময়টা তখন ১৮৬৯। আজকের বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ আমেরিকায় তখন ভয়াবহ মন্দা চলছিলো। বিষয়টি নিয়ে আমেরিকানরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা ভাবতে শুরু করে কিভাবে এই মন্দা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এক সময়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে একটি বিশেষ দিনে তারা তাদের পন্যের উপর বিশাল অংকের ছাড় দিবে যাতে মানুষ কেনাকাটায় আগ্রহী হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজ। সে বছরের থ্যাঙ্কস গিভিং ডে এর পরের দিন ব্ল্যাক ফ্রাইডে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আর মানুষও এতে বেশ সাড়া দেয়। প্রথম বছরেই ব্যবসায়ীরা তাদের সিদ্ধান্তে বেশ সফলও হয়। আর এর পর থেকে দিনটি আমেরিকার মানুষের কাছে একটি বিশেষ দিনে পরিণত হয়ে যায়। সে থেকে প্রতি বছর থ্যাঙ্কস গিভিং ডে এর পরের দিন ব্ল্যাক ফ্রাইডে হিসেবে উদযাপন করা হয়।

আমেরিকার প্রভাবশালী পত্রিকা, নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯৭৫ সালে এই দিনটিকে সে বছরের ব্যস্ততম কেনাকাটা ও ট্র্যাফিক জ্যামের দিন হিসেবে উল্লেখ করেছিলো।

তবে একটু দুঃখের স্মৃতিও যোগ হয়েছে এর সাথে। আর তা হচ্ছে ২০০৬ সালে এই দিবস উদযাপন করতে গিয়ে মানুষের দলাদলিতে ১২ জন মারা যায় এবং প্রায় ১১৮ জন আমেরিকান আহত হয়।

গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে অনলাইনে ব্ল্যাক ফ্রাইডের মোট বিক্রি ১৪.১৩ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। থ্যাঙ্কস গিভিং ও ব্ল্যাক ফ্রাইডের এই সপ্তাহে ১৮৬.৪ মিলিয়ন ক্রেতা কেনাকাটা করে। ব্ল্যাকফ্রাইডে ডট কম এর তথ্য অনুসারে ২০২০ সালে ৫০% ক্রেতা পোশাক, ৩৯% মানুষ বাসার জিনিপত্র/ছোট যন্ত্রপাতি, ২১% খেলনা ও গিফট আইটেম, ২০% কম্পিউটার সামগ্রী, ১৭% মানুষ টিভি/মনিটর, ১৬% মানুষ গেমিং পন্য ক্রয় করেন।

২০১৯ সালে যার পরিমাণ ছিল ১৮৯.৬ মিলিয়ন। মূলত করোনার কারনে এর হার ১.৭% কমে গিয়েছিলো। তবে ২০২১ সালে তা পূর্বের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কখন বিক্রি শুরু হয়

বৃহস্পতিবার রাত ১২ টার পর থেকেই অর্থাৎ শুক্রবার শুরু হতেই মধ্য রাতে ব্ল্যাক ফ্রাইডের বিক্রি শুরু হয়ে যায়। আর মূল্য ছাড়ের বেচাকেনা চলে রাত ১২ টা পর্যন্ত। তবে বর্তমানে অনেক অনলাইন শপ ব্ল্যাক ফ্রাইডের কয়েকদিন আগে থেকেই এই অফার দেওয়া শুরু করে।

ব্ল্যাক ফাইডে কেনাকাটার প্রস্তুতি

যেহেতু ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে বিভিন্ন অনলাইন শপগুলো ও বিক্রেতারা তাদের পন্যের উপর বিশাল ছাড় দেয়। সেহেতু সবাই এই বিশেষ দিনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এর ফলে এক দিকে যেমনি বেশি চাহিদা বেশি অপর দিকে নির্দিষ্ট সংখ্যক পন্যের উপর ছাড় দেওয়া হয়। সেহেতু দেরি করলে আপনার পছন্দের ও প্রয়োজনীয় পণ্যটি শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই আগে আগে অর্ডার কমপ্লিট করার চেষ্টা করুন। দরকার ভেদে মোবাইলে এলারম দিয়ে রাখতে পারেন যাতে সময় ভুলে বা ঘুমিয়ে না যান।

প্রয়োজনীয় পন্যের তালিকা তৈরি করুন। মূল্য ছাড়ের কারনে অনেকে প্রয়োজন নেই তবুও কিনে নেয়। এটা এক ধরনের বাজে অভ্যাস। এতে অর্থের অপচয় হয়। তাই ব্ল্যাক ফ্রাইডে বা কোন বিশেষ মূল্য ছাড়ে কোন কিছু কেনার আগে আপনার প্রয়োজনীয় পন্যের তালিকা তৈরি করুন এবং সেগুলো খুঁজুন।

ভেরিফাইড সেলার। ই-কমার্স সাইটে নিজেরা পন্য বিক্রি করে না। এখানে হাজার হাজার বিক্রেতা রয়েছে। তাই আগে থেকে ভেরিফাইড সাইট ও সেলার গুলোর নাম নোট করে রাখতে পারেন। এবং ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে ওই সকল স্টোরগুলো ভিজিট করে আপনার পছন্দের ও প্রয়োজনীয় পন্যগুলো অর্ডার করুন।

বাংলাদেশে ব্ল্যাক ফ্রাইডে

আমেরিকা আর বাংলাদেশের সংস্কৃতি এক না। আর এ কারনেই আমাদের দেশের মানুষের কাছে ব্ল্যাক ফ্রাইডে পরিচিতও ছিল না। তবে বর্তমানে অনলাইনে ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল বেশ জমে উঠেছে।

বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন বিদেশী ও দেশীয় অনলাইন শপগুলোতে ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে বিশেষ ডিসকাউন্টে পন্য বিক্রির প্রচলন বেড়েছে। তবে পন্যের মূল্য বাড়িয়ে মূল্য ছাড় দেওয়ার অভিযোগও আছে ক্রেতা সাধারনের।

আপনার কি ব্ল্যাক ফ্রাইডে উদযাপন করা উচিত?

ব্ল্যাক ফ্রাইডে যেহেতু কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন না। এই দিনে আপনি মুসলিম বা অন্য ধর্মের অনুসারী হলে ধর্মীয় সীমারেখা মেনে ব্যবসা বাণিজ্য করলে অসুবিধা নেই। এই দিনে বিক্রেতারা তাদের পন্যের উপর মূল্য ছাড় দিয়ে থাকে। এতে তাদের বিক্রি বাড়ার পাশাপাশি পন্যের প্রচার হয়। অপরদিকে ক্রেতারাও লাভবান হয়। কম দামে প্রয়োজনীয় পন্য কিনতে পারে। তবে বাংলাদেশে রোজা, ঈদ, পূজার সময়ে এরকম মূল্য ছাড়ের রেওয়াজ শুরু হলে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়েই লাভবান হবে। চাঙ্গা হবে দেশের অর্থনীতি।

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে ব্যবসায়ী শ্রেণীর মাধ্যে এই ধরনের ভালো কাজের আগ্রহ একদমই নেই। লোভী মহলের এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কারন এতে শুধু ক্রেতারাই লাভবান হবে না বরং বিক্রেতার সুনাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বার্ষিক মোট বিক্রিও কয়েকগুন বৃদ্ধি পাবে।

কিছু কথা না বলেই না

আমেরিকনারা তাদের সংস্কৃতির ব্যাপারে খুব সজাগ। তারা তাদের নিজেদেরকে অন্য দেশ ও মানুষের কাছে যতটা প্রচার করে অন্য দেশের মানুষের সংস্কৃতি তারা সহজে গ্রহণ ও উদযাপন করে না।

বাংলাদেশের চিত্র কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন, কবে যেন হঠাৎ করে বাংরেজি শিখে গেলাম। এখন কথার মধ্যে ফুটুস ফাটুস দুইটা ইংরেজি না বললে চলেই না একদম।এদের অবস্থা এমন যে বাংলা বলতে বললে বলবে, “হ্যাই ম্যান আমি বাংলাহ বলথে ফারি না”। আর চলাফেরা, পোশাক, অনুষ্ঠানের মধ্যে দুই চারটা বিদেশী ডোজ না ডুকালে আমাদের অনুষ্ঠানগুলো জমেই না। (আমি সকলের পছন্দকে সম্মান করেই বলছি, কেবলমাত্র আমার সংস্কৃতির বর্তমান অবস্থা বুঝানোর চেষ্টা করছি)।

ভুং ভাং চলাফেরা আর বাংলা ভাষার ১৩টা বাজাতে আমরা যতোটা এগিয়ে, ঠিক ভালো কাজগুলো থেকে তার চেয়ে কয়েকগুন পিছিয়ে। আমাদের দেশেও অনেক বিশেষ দিবস রয়েছে। দেশের মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের দামে নাভিশ্বাস প্রায়। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা তাদের পন্যের উপর ছাড় দেওয়ার কথা কল্পনাতেও ভাবতে পারে না। উল্টো বাজারে পন্যের যোগান কমিয়ে দিয়ে বাড়তি মুনাফা লাভের নেশায় বিভোর থাকে। রমজান আসলে এই চিত্র আরও জঘন্য হয়ে ওঠে।

সর্বশেষ

আক্ষরিক অর্থে কালো শুক্রবার হলেও আসলে এই দিনে ব্যবসায়ী ক্রেতা উভয়ে কিন্ত লালে লাল হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা এই দিনের সুফল সরাসরি না পেলেও ব্রান্ডিং তৈরি ও সুনাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ী শ্রেণীর এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।

প্রিয় পাঠক, লেখাটি কেমন লেগেছে আপনাদের জানাতে পারেন আমাদের ফেসবুক পেজে। বাংলা ভাষায় নিয়মিত টিপস পড়তে ভিজিট করুন আপনাদের প্রিয় টিপসওয়ালী ডট কম।