প্রাচীনকাল হতে ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে চিরতা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সম্মানিত ভিজিটর আজকের লেখাজুড়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো- চিরতা কি, এর গুনাগুন, খাওয়ার উপকারিতা, খাওয়ার নিয়ম, চিরতার পুষ্টি গুন দাম, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ক্ষতি, কোথায় কিনতে পাওয়া যায় এসব নিয়ে বিস্তারিত।
চিরতা কি?
চিরতার ইংরেজি প্রতিশব্দ Swertia হিন্দিতে একে চিরায়াতা বলা হয়ে থাকে। চিরতা মূলত একটি ভেষজ উদ্ভিদ যা ভেষজ চিকিৎসা ও চিকিৎসা সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর এক একটি গাছের উচ্চতা প্রায় দেড় থেকে দুই মিটার। মূলত ফুল থাকা আবস্থায় পুরো গাছ তুলে রোদে শুকিয়ে ঔষধ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়।
কালোমেঘ ও চিরতা
আমাদের দেশে অনেকে চিরতা ও কালোমেঘ কে একই মনে করে। এর কারন হচ্ছে কালোমেঘের ইংরেজি নামের অর্থ হচ্ছে সবুজ চিরতা। আসলে কালোমেঘ বা সবুজ চিরতা সম্পূর্ণ আলাদা।
চিরতার গুনাগুন
বনে কিংবা রাস্তার ধারে জন্মালেও এই উদ্ভিদের রয়েছে চমৎকার গুনাগুন। চিরতা অনেক তেতো, যা জ্বর, কৃমি দূর করতে, চুলকানি, ম্যালেরিয়া, হাপানির চিকিৎসায় বেশ কার্যকরী।
চিরতা খাওয়ার উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম
চলুন এ পর্যায়ে চিরতা খাওয়ার নানা উপকারিতা ও খাওয়ার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১) কাটা স্থান বা ক্ষত শুকাতে
কোথাও আচর লেগে কিংবা কোন কিছু কাটাকাটি করতে গিয়ে আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান কেটে ছিড়ে যায়। সামান্য কাটা শুকাতেও অনেকের বেশি সময় লেগে যায়। অনেক সময় ঘা হয়ে যেতে বসে। এই সমস্যা সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চিরতার ব্যবহার করা যেতে পারে।
পানি ফুটিয়ে ছাকুনি দিয়ে একটি কাপে এক কাপ গরম পানি নিন। ঘুমানোর আগে রাতে এক কাপ গরম পানিতে ৫-৭ গ্রাম চিরতা ভিজিয়ে রাখুন। সকালে চিরতা ভেজানো পানি ছেকে ওই পানি দিয়ে পচা ঘা ধুয়ে ফেলুন। এভাবে ৩-৪ দিন নিয়মিত করার চেষ্টা করুন। আশা করা যায় ৪-৫ দিনের মধ্যেই ভালো ফলাফল পাবেন।
২) জ্বর সারাতে চিরতা
জ্বর সারাতে চিরতার ব্যবহার সব থেকে বেশি। সিজন পরিবর্তনের কারনে আমাদের অনেকের মধ্যে ঠাণ্ডা জ্বর দেখা দেয়। অনেকের রাতে জ্বর আসার মতো সমস্যা রয়েছে। বলতে গেলে বছরের বারো মাসই প্রতি রাতে জ্বর আসে। আর মনে হয় শরীর-হাত-পা কামড়ায়।
আপনার মধ্যেও এই সমস্যা থেকে থাকলে আপনি ৮-১০ গ্রাম পরিমান চিরতা ৮-৫ কাপ পানিতে দিয়ে সিদ্ধ করুন। পানি টেনে ২-৩ কাপ পরিমাণ হয়ে গেলে চুলা বন্ধ করে দিন। এবার পানি ছেকে সকালে খালি পেটে অর্ধেক ও বিকালে অর্ধেক পরিমান পান করুন। তবে গর্ভবতী ও শিশুদের খাওয়ানোর আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৩) হাপানি দূর করতে
আমাদের আশেপাশে অনেকেরই হাপানির সমস্যা দেখা যায়। হাপানির চিকিৎসায় চিরতার বেশ সুনাম রয়েছে। আপনার কিংবা আপনার পরিবারের অথবা পরিচিত কারো হাপানির সমস্যা থেকে থাকলে তাকে চিরতা খাওয়ার জন্য বলতে পারেন।
হাপানি চিকিৎসায় চিরতা খাওয়ার নিয়ম হচ্ছে, হাফ (১/২) গ্রাম চিরতার গুঁড়ার সাথে পরিমান মতো মধু নিয়ে হাত পরিষ্কার করে চেটে চেটে খান। আশা করা যায়, প্রবল হাপানি থাকলেও ২-৩ দিনের মধ্যেই ভালো একটা সমাধান আসবে।
অনেকের একজিমার সাথে হাপানি কিংবা সিজন পরিবর্তন জনিত কারনে হঠাৎ কাশি ঠাণ্ডা বেড়ে যায়। তারাও একই পদ্ধতিতে চিরতা গুঁড়া ও মধু খেতে পারেন।
৪) চুল পড়া কমাতে
আমাদের মধ্য এনেকেরই মাথার চুল পড়া জনিত সমস্যা রয়েছে। সবারই কম বেশি চুল পড়ে। তবে গজানোর তুলনায় বেশি চুল ঝরে গেলে সমস্যা। চুল পড়া শুরু করলে মাথা টাক হতে বেশি সময় লাগে না। যদিও টাক হরমোন জনিত কারনেই বেশি হয়ে থাকে।
হঠাৎ আপনার মাথার চুল পড়া শুরু করলে। এক কাপ পরিমান গরম পানিতে ৫-৭ গ্রাম চিরতা ভিজিয়ে রাখুন। সকালে পানি ছেকে নিয়ে সেই পানি দিয়ে মাথা ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। মাথা নিচু করে বা বেসিং এ গিয়ে স্যাম্পুর মতো করে মাথায় দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৫) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
বর্তমান সময়ে ডায়াবেটিস বলতে গেলে প্রকট আকার ধারন করছে। ছোট থেকে বয়স্ক সকল বয়সী মানুষের ডায়াবেটিস হতে পারে। বিশেষ করে মোথা বা স্থুলকায় ও বয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। চিরতা রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে। ডায়াবেটিস এর মত্রা কমিয়ে আনতে আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা চিরতার পানি খালি পেটে খেতে হবে।
৬) চুলকানি সারাতে
শরীরে চুলকানি জনিত সমস্যা থাকলে ২০ থেকে ২৫ গ্রাম চিরতা নিন। এতে সামান্য পানি ছিটিয়ে বেটে বা ব্লেন্ডার দিয়ে স্মুথ করে নিন। ছেঁচা শেষ হয়ে গেলে লোহার কড়াই নিন। ১০০ গ্রাম পরিমান সরিষার তেল দিয়ে জ্বাল দিন। তেল ফুটালে ফেনা জাগবে। ফেনা কমে গেলে ফুটন্ত তেলে ভেজে চুলে বন্ধ করে দিন। খেয়াল রাখুন যেন পুড়ে না যায়।
এবার তেল ছেকে নিন। এবং যে সকল যায়গায় চুলকায় সেসব যায়গায় এই এই তেল দিয়ে আস্তে আস্তে মালিশ করুন। খেয়াল রাখবেন কাটা যায়গায় চুলকানি থাকলে সে সব যায়গায় এই তেল ব্যবহার করা যাবে না।
এছাড়াও হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস, ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায়, হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চিরতার পানি পান করতে পারেন।
কোথায় পাওয়া যায়
গ্রামের রাস্তার আশেপাশেই প্রচুর চিরতা জন্মাতে দেখা যায়। তবে আপনার এলাকায় না পাওয়া গেলে দোকান থেকে কিনে নিতে পারেন। আজকাল অনলাইন শপগুলোতেও চিরতা ও এর গুঁড়া কিনতে পাওয়া যায়।
চিরতার দাম
ঔষধিগুন সমৃদ্ধ চিরতার দাম কিন্তু খুবই নাগালের মধ্যে। এটি অত্যান্ত তেঁতো তাই সামান্য পরিমান নিলেই হয়ে যায়। ১০০ গ্রাম বাছাই করা শুকনো চিরতার দাম ১০০ থেকে ১২০ টাকা।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও অপকারিতা বা ক্ষতি
উপকারের পাশাপাশি মাত্রারিক্ত চিরতার পানি পান করলে হিতের বিপরীত হতে পারে। একটানা বেশি পরিমান কিংবা ১০ থেকে ১৫ দিনের বেশি চিরতা খাওয়া উচিত না। গর্ভবতী মায়াদের ও শিশুদের খাওয়ানোর আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। অবশ্য সামান্য পরিমান দিয়ে খাওয়া শুরু করুন।
চিরতা চাষ
বাজারে বেশ ভালো চাহিদা থাকার কারনে আজকাল বাণিজ্যিক ভাবেও চিরতার চাষ করা হয়। আপনি চাইলে বাসার আঙ্গিনায় শুষ্ক ও উচু স্থানে এর চাষ করতে পারেন। সাধারণত বিনা যত্নেই এই গাছ বেড়ে ওঠে। আপনাকে অতিরিক্ত শ্রম বা সার প্রয়োগ করতে হবে না। এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আপনার নিকটস্থ কৃষি উন্নয়ন কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন। তারা আপনাকে চিরতা চাষে সর্বাত্মক সাহায্য করবে।
সম্মানিত ভিজিটর আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। কোন প্রশ্ন, মতামত, পরামর্শ কিংবা অভিযোগ থাকলে যোগাযোগ করুন আমাদের ফেসবুক পেজে। লেখাটি উপকারী মনে হলে শেয়ার করুন আপনার কাছে মানুষের মাঝে।