দধি বা দই নাম শুনলেই চোখের সামনে সাদা দুগ্ধজাত খাবারের ছবি ভেসে আসে। প্রিয় পাঠক আজকের লেখাজুড়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে, দই বা দধি কি, বগুড়ার বিখ্যাত দইয়ের ইতিহাস, মিষ্টি ও টক দই বানানোর নিয়ম বা পদ্ধতি, এর উপকারিতা, অপকারিতা, রূপচর্চায় দধির ব্যবহার সহ আরও অনেক বিষয় বিস্তারিত।
দই কি
দই হচ্ছে এক প্রকার দুগ্ধজাত খাবার যা দুধের ব্যাকটেরিয়ার গাঁজনের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। দইকে অনেকে দধিও বলে থাকে। দই/দধি এর ইংরেজি অর্থ Yogurt (ইয়োগার্ট).
Yogurt/দই এর ইতিহাস
কোথায় বা কবে কে প্রথম দধি তৈরি করেছিল সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও ধারনা করা হয় যে, প্রায় ৪৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ দই তৈরি করে আসছে। নানা পুষ্টি উপাদান ও সুস্বাদু হওয়ার কারনে বিশ্বের সব দেশেই এটি পরিচিত।
দই এর পুষ্টিগুণ
শুধু স্বাদের জন্য না, পুষ্টিগুনের জন্যও দুগ্ধজাত এই খাবারটি অনেকের পছন্দ। দইয়ের পুষ্টিগুন শুনলে আপনি অবাক হয়ে যেতে পারেন। এতে রয়েছে প্রোটিন, স্নেহ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-বি৬, ভিটামিন-বি১২, রাইবোফ্ল্যাভিন। এছাড়াও একদল গবেষক দাবি করেন দধি মানুষের পাকস্থলীতে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করে যা মানুষের শরীরকে রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আপনার দেহকে সুরক্ষিত রাখে ও খাবার হজম ক্ষমতা বাড়ায়।
কি কারনে বগুড়ার দই বিখ্যাত
বগুড়ার নাম মুখে উচ্চরন করলেই সুস্বাদু দইয়ের কথা মনে পড়ার পাশাপাশি জিহ্বায় পানি চলে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে সে সময় তো এতো ডিজিটাল মাধ্যেম ছিলো না কীভাবে বগুড়ার দইয়ের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো!
তৎকালীন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবারের জন্য গৌর গোপাল পাল নামের এক দই প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা দই সরবরাহ করতেন। তার দইয়ের স্বাদ নবাব পরিবাবের সদস্যদের প্রশংসা কুড়োয়। আর তখন থেকেই ওই অঞ্চলের ও পরবর্তী সময়ে আশেপাশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। লোকমুখে শোনা যায় তৎকালীন ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথ বাংলায় আসলে তাকে গৌর গোপাল পালের দধি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এবং এটি এক সময়ে নবাব বাড়ির দই নামে পরিচিত লাভ করে। আর এই সকল কারনে বগুড়ার দধি বিখ্যাত।
দইয়ের প্রকারভেদ
স্বাদ ও বানানোর পদ্ধিতির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রকারের দই রয়েছে। স্বাদের দিক থেকে দই দুই প্রকার মিষ্টি ও টক। হিমায়িত বা ফ্রজেন, কেফির (পাতলা), ক্রিম, স্কাইয়ার, লো ফ্যাট বা নো-ফ্যাট।
মিষ্টি দইয়ের উপকারিতা
বেশির ভাগ মানুষ মিষ্টি দই খেতে পছন্দ করে। দই-চিড়া এর নাম মুখে আনলে মিষ্টি ইয়োগার্ট আর ঘোল ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করাই পাপ। সাথে দুই একটা রসগোল্লা হলে তো কথাই নেই। গরমের দিনে সে কি স্বাদ। যাহোক চলুন মিষ্টি দই এর উপকারিতা জেনে নেওয়া যাকঃ
স্বাদের পাশাপাশি পুষ্টিগুনেও এগিয়ে আছে মিষ্টি দধি। এটি আপনাকে খাবারে থাকা বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদন থেকে নিষ্কৃতি দিবে। এবং আপনার পাকস্থলীকে সুস্থ রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে মিষ্টি দইয়ে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন-বি৬ ও প্রচুর পটাশিয়াম। যা আপনার খাবার হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এবং এর উপকারী ব্যাকটেরিয়া কোষ্ঠকাঠিন্য ও এসিডিটি দূর করে থাকে।
মিষ্টি দই তৈরির রেসিপি
প্রিয় ভিজিটর আপনি চাইলে ঘরে বসেই খুব সহজে মিষ্টি দধি তৈরি করে ফেলতে পারেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে মিষ্টি দই তৈরি করবেন বা বানানোর সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কেঃ
প্রয়োজনীয় উপকরন
১.৫ লিটার দুধ, ১ কাপ পানি, ২০০ গ্রাম চিনি, দইয়ের বীজ ১/২ টেবিল চামচ (টাটকা দধি), একটি মাটির পাত্র ও অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল। বীজ না থাকলে ২ টেবিল চামচ দুধ কমিয়ে নিন। এবং এক কাপ দুধে এক কাপ গুঁড়া দুধ দিয়ে নিন এবং ভালোভাবে জ্বালিয়ে নিন। যা আপনার জন্য বীজ হিসেবে কাজ করবে।
যেভাবে বানাবেন
দুইটি চুলা থাকলে আপনার কাজ সহজ হবে একটি চুলায় দুই লিটার দুধ দিয়ে জ্বাল দিতে থাকুন এবং ব্লক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। ব্লক হয়ে গেলে চুলা বন্ধ করে দিন।
এ পর্যায়ে ক্যারামেল তৈরি করে নিন। এ জন্য একটি পরিষ্কার অ্যালুমিনিয়াম এর পাত্রে এক কাপ চিনি অথবা আপনাদের পছন্দ মতো দিন এর সাথে এক কাপ পানি দিয়ে মিডিয়াম তাপে অনবরত নাড়তে থাকুন এবং মধুর মতো কালার হওয়ার পর চুলা বন্ধ করে দিন।
এ পর্যায়ে ক্যারামেল এর সাথে ব্লক আনা দুধ হতে এক কাপ দুধ নিয়ে একটু নাড়ুন। এর এক দুই মিনিট পর আবার চুলা জ্বালিয়ে মিডিয়াম তাপে অনবরত নাড়তে থাকুন। দ্রুত গলাতে আরও এক কাপ ব্লক আনা দুধ দিয়ে দিতে পারেন। এভাবে ৫-১০ মিনিট নাড়তে থাকুন।
এখন ক্যারামেল ব্লক আনা দুধে ঢেলে দিন এবং চুলা মিডিয়াম থেকে একটু সামান্য বেশি দিয়ে নাড়তে থাকুন। দুই লিটার দুধ ১.৫ লিটারের নিচে নামিয়ে নিয়ে আসুন।
চুলা বন্ধ করে ধীরে ধীরে নাড়তে থাকুন এবং কুসুম গরম বানিয়ে ফেলুন। মোটামুটি সামান্য গরম আছে এমন অবস্থায় হাফ কাপ গুঁড়া দুধ দিয়ে দিন। এবং ভালোভাবে নাড়তে থাকুন।
দেড় কাপ টক দই নিন সম্ভব হলে একটি ছাকুনি দিয়ে ছেকে পানি ঝরিয়ে নিন। একটি বাটিতে নিয়ে এর সাথে কয়েক চামচ জ্বালানো দুধ দিয়ে মিক্সারের সাহায্যে ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে ক্যারামেল ও দুধ মেশানো পাত্রে ঢেলে দিন। এবং একটু নাড়ুন।
ধীরে ধীরে পরিষ্কার মাটির পাত্রে ঢালুন এবং একটি অ্যালুমিনিয়ামের বড় পাত্র চুলার উপর বসিয়ে এর মধ্যে মাটির পাত্রতি বসিয়ে দিন এবং একটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন। সবচেয়ে ভালো হয়ে অ্যালুমিনিয়ামের বড় পাতিলের মধ্যে পাতিল রাখার একটি স্ট্যান্ড দিয়ে স্ট্যান্ড সমপরিমান পানি দিয়ে দিলে। এতে সরাসরি তাপ লাগবে না।
একদম সামান্য তাপে ২০/৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। দেখলেই বুজতে পারবেন যে মাটির পাত্রে থাকা দই প্রস্তুত হয়ে গেছে। চুলা থেকে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে নিন এবং ফয়েল পেপার বা পলি দিয়ে ঢেকে দিন। এবং ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডা করে। পরিবেশন করুন।
টক দইয়ের উপকারিতা
যদিও মিষ্টি দই খেতে বেশি সুস্বাদু তবে গুন ও উপকারিতার দিক দিয়ে টক দই বেশি এগিয়ে আছে। এটিকে প্রোবায়োটিক খাদ্য বলা হয়। এতে থাকা ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের ও পাকস্থলীর উন্নতি সাধন করে। এতে ফ্যাট কম থাকায় রক্তচাপ কমায়। তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের জন্য টক দই বেশ উপকারী। এছাড়া প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম তো থাকছেই।
টক দধি তৈরি করার উপায়
আপনি চাইলে ঘরে বসেই খুব সহজে টক দই বানিয়ে নিতে পারেন এজন্য আপনাকে তেমন কোন ঝামেলা করতে হবে না। চলুন জেনে নেওয়া যাক টক দই তৈরি করতে কি কি প্রয়োজনঃ দুধ দেড় লিটার, গুঁড়া দুধ আধা কাপ, ও চার চামচ টাটকা টক দই।
পস্তুত প্রণালী
প্রথমে চুলায় মিডিয়াম তাপে দুধ জ্বালিয়ে ঘন করে নিন। দেড় লিটারকে এক লিটার বানিয়ে ফেলুন। এবং চুলা বন্ধ করে দিন।
এবার বাজার থেকে আনা বীজ ফ্রিজ থেকে বের করে একদম নরমাল করে ফেটে নিন এবং জ্বালানো দুধে দিয়ে দিন। এবং ভালো ভাবে নাড়িয়ে নিন। আপনি চাইলে বাসায় থাকা দইও ব্যবহার করতে পারেন।
হাত দেওয়া যায় এমন সামান্য কুসুম গরম দুধ মাটির পাত্রে ঢালুন। এ পর্যায়ে বাসায় অ্যালুমিনিয়ামের বড় পাত্র থাকলে সেটির মধ্যে কাপড় দিয়ে তার উপরে দুধ দেওয়া মাটির পাত্রটি বসিয়ে পাত্রে একটি ঢাকনা দিয়ে ৬-৮ ঘণ্টা রেখে দিন। হয়ে গেল আপনার টক দধি তৈরি।
দই খাওয়ার অপকারিতা
মিষ্টি দইয়ের তুলনায় টক দই বেশি উপকারী। উপকারিতার পাশাপাশি অপকারিতা আছে তবে তা নির্ভর করবে আপনার উপর। আপনি যদি একজন ডায়াবেটিকসের রোগী হয়ে থাকেন কিংবা আপনার কিডনি জনিত কোন সমস্যা থাকে তবে এটি আপনার জন্য উপকারের বদলে ক্ষতির কারন হয়ে দাড়াতে পারে। এরকম সমস্যা থাকেল চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং দেখুন তারা কি পরামর্শ দেয়। পাশাপাশি ইচ্ছামতো অতিরিক্ত দই খাওয়াও ক্ষতিকর। এছাড়া কারো শরীরে অ্যালার্জি জনিত সমস্যা বেশি থাকলে এতে থাকা প্রোটিনের কারনে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কি পরিমান দই খাওয়া ভালো
যদিও দই খাওয়ায়র নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই তবে অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না। প্রদিনের খাদ্য তালিকার পাশাপাশি ২০০ থেকে ৮০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত দই খাওয়া যেতে পারে। বাজার থেকে কিনে আনার চেয়ে ঘরে পাতা ইয়োগার্ট খাওয়া উত্তম। মনে রাখবেন ২৮ ঘণ্টা পাড় হলেই দধির পুষ্টিগুন কমতে থাকে।
রুপচর্চায় দই এর ব্যবহার
ব্রন দূর করা থেকে স্কিনের যত্নে টক দধির ব্যবহার অনেক আগে থেকে। আপনার মুখে ব্রন দেখা দিলে এক টেবিলচামচ টক নিয়ে এতে পরিষ্কার তুলা ভিজিয়ে ব্রনের উপর লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। বা কয়েক ঘণ্টা রাখুন। এবং ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন কয়েকদিনের মধ্যেই ভালো ফলাফল আসবে। ব্রন দূর করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন এখানে।
ডার্ক সার্কেল দূর করতেও এটি বেশ কার্যকরী। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল দেখা দিলে দইয়ের মধ্যে সামান্য পরিষ্কার তুলা ভিজিয়ে চোখের পাশে কালো যায়গায় ১০-১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
চুলের যত্নে দই এর ব্যবহার
চুলের যত্নে বিভিন্ন দইয়ের প্যাকের ব্যবহার দেখা যায়। খুশকি দূর করতে এক কাপ দইয়ের সাথে পাঁচ চামচ মেথি গুঁড়ো ও এক চা চামচ লেবুর রস একসাথে মিশিয়ে আপনার চুলে মাখুন। ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পর একটা হারবাল শ্যাম্পু দিয়ে চুলে ধুয়ে ফেলুন। এক সপ্তাহে দুই দিন ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল আসবে।
প্রিয় পাঠক, আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। আপনার মতামত, পরামর্শ কিংবা অভিযোগ থাকেল লিখতে পারেন আমাদের ফেসবুক পেজে। লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন আপনার প্রিয়জনের সাথে।