রূপচর্চায় কিংবা চিকিৎসায় মধু নামক এই ভেষজ উপাদানের রয়েছে হাজারো গুনাগুন। প্রাচীনকাল থেকেই নানা চিকিৎসায় ও রূপচর্চায় মধুর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আজকের লেখায় কথা হবে, মধু কি, কিভাবে সংগ্রহ করা হয়, কিভাবে চাষ করা হয়, খাঁটি মধু চেনার উপায় কি, এবং কোথায় খাঁটি মধু কিনতে পাওয়া যায়।
Honey বা মধু কি?
ইংরেজিতে Honey আর বাংলায় মধু হচ্ছে এক প্রকার তরল আঠালো মিষ্টি জাতীয় পদার্থ , যা মৌমাছি ফুলের পরাগরেনু থেকে সংগ্রহ করে মৌচকে জমা রাখে। এটি একটি অগাঁজানোশীল মিষ্টি জাতীয় পদার্থ। মৌমাছি ফুলের নেকটার বা জীবন্ত গাছপালার নির্গত রস থেকেও সংগ্রহ করে। এটি শরীরের জন্য উপকারি এবং নিয়মিত সেবন করলে অসংখ্য রোগবালাই থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
মধু কিভাবে সংগ্রহ করা হয়?
বর্তমানে বাজারে দুই ধরনের মধু পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক মৌচাক থেকে আহরণ করা আর অন্যটি হচ্ছে চাষ করা. তো প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক কিভাবে মৌয়াল মৌচাক হতে মধু সংগ্রহ করে থাকে।
মৌয়াল যেভাবে মধু সংগ্রহ করে
যারা সুন্দরবন হতে মধু সংগ্রহ করে থাকে তাদের মৌয়াল বলা হয়। এক এক দলে সাধারনত ৭-১২ জন সদস্য থাকে। বাংলাদেশের বোন বিভাগ তিন মাসের জন্য Honey সংগ্রহের অনুমতি দেয়। একজন নৌকা পাহারায় থাকে বাকিরা বনে ঢুকে পড়ে। মৌচাকে যেহেতু মৌমাছি থাকে তাই এদের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য মৌয়াল মুখ চোখ ভালো ভাবে আটকে নেয়। ও বিশেষ পোশাক পড়ে।
সবাই ভালো করে গাছের ডালে খেয়াল করে এবং খেয়াল করে মৌচাক আগে কাটা হয়েছে কিনা বা কাটার উপযোগী কিনা। মৌয়ালদের সরদারকে বহরদার বলা হয়। তিনি অনুমতি দিলে গাছে উঠে আগুনের ধোঁয়া দেওয়া হয় এতে মৌমাছি দূরে চলে যায় এবং ধামা পেটে মৌচাক কাটা হয়। এবং সংগ্রহ করে বাসায় ফিরে আসে।
কিভাবে মধু চাষ করা হয়?
বর্তমানে কাঠের বক্সে বিশেষ পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। আপনি নিজেও চাইলে চাষ করতে পারেবন। তবে এজন্য আপনাকে অবশ্যই বসতভিটা হতে নির্দিষ্ট ও নিরাপদ দূরত্বে মধু চাষের জন্য বেছে নিতে হবে।
সরিষা ক্ষেতে চাষ করা সব চেয়ে উত্তম কিংবা আসে পাশে ফুল বাগান আছে এমন সব জায়গা এই মহা-ঔষধ চাষের জন্য উত্তম। জায়গাটি অবশ্যই ছায়াযুক্ত ও শুকনা হতে হবে। বাজারে মৌবাক্স কিনতে পাওয়া যায়।
কোন গাছের চাক হতে মৌমাছি ও তাদের চাক সংগ্রহ করে বাক্সে দিতে হয়। বাকি কাজ মৌমাছি ই করবে। অর্থাৎ বাচ্চা দেওয়া, চাক তৈরি, ফুল থেকে সংগ্রহ ইত্যাদি।
আপনার নিকটস্থ কৃষি অফিসে যোগাযোগ করলে ওনারা আপনাকে উৎপাদন ও চাষে সার্বিক পরামর্শ ও সহয়তা দিয়ে থাকবে।
মধুর উপকারিতা কি
মধু আমদের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে একটি বিশেষ নেয়ামত। কুরআনে এবং হাদিসে এটি সম্পর্কে অনেক গুনাগুনের কথা বলা হয়েছে। রাসুল (স.) একে মহৌষধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটি দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে। এতে যে শর্করা রয়েছে তাতে এটি সহজেই হজম হয়। এতে যে ডেক্সট্রিন থাকে তা সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে এবং তা তাৎক্ষনিক কাজ করে। এছাড়া প্রতিদিন সকালে এক চামচ করে মধু পান করলে ঠাণ্ডা, কফ, কাশি, শ্বাসকষ্ট থাকে না। এটি ফুসফুসের যাবতীয় রোগের জন্য উপকারি। এতে রয়েছে প্রাকৃতিক চিনি যা শরীরকে কর্মক্ষম রাখে।
এটি শরীরের দুর্বলতা ও চা, কফির নেশা কমায়। যাদের অনিদ্রার সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটি খুবই উপকারি। রাতে গুমানোর আগে এক গ্লাস পানির সঙ্গে দুই চা চামচ মধু মিশিয়ে খেলে আপনার ভালো গুম হবে। যাদের যৌন দুর্বলতা রয়েছে তারা প্রতিদিন ছোলা ও মধু মিশিয়ে খান তাহলে ভালো উপকার পাবেন।
এটি রক্তশূন্যতা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এছাড়াও এটি হাপানি রোধ ও রক্তের উচ্চ চাপ কমায়।এছাড়া শরীরের ভেতর ও বাইরের যেকোনো ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ রোধ করে। কারন মহৌষধিতে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধকারী উপাদান। মধুতে রয়েছে ক্যালসিয়াম যা দাত, হাড়, নখের ভঙ্গুরতা রোধ করে এবং চুলের গোঁড়া শক্ত করে।
খাঁটি মধু চেনার উপায় কি
নকল মধু স্বাস্থের জন্য কোনো উপকারে আসেনা। বরং স্বাস্থের ক্ষতি করে। তাই আসল-নাকল না দেখে কিনলে আপনার অর্থ অপচয় তো হবেই আর স্বাস্থের ক্ষতি তো আছেই।
- খাঁটি না হলে তা অন্য সব তরলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আপনি সামান্য পরিমাণ Honey ভুঁড়ো আঙ্গুলের ওপর নিলে দেখবেন তা ছড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু নকল হলে তা অন্য সব তরলের মতো সবদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আসল মধু ঘন হয়ে আটকে থাকবে। আবার উল্টো করলে তা থেকে সহজে ফোটা আকারে পড়বে না।
- একটি গ্লাসে পানি নিন এবং এতে মধু দিন। বেজাল মধু শিগ্রই পানির সাথে মিশে যাবে। আসল মধু মিশে গেলেও এর কিছু অংশ ঘন হয়ে ভেসে বেড়াবে। বিশেষ করে সামান্য Honey তলানি হিসেবে থাকবে। কিন্তু নকল মধু একেবারে হাওয়া হয়ে যাবে।
- একটি কাপে মধু নিন এতে সামান্য পরিমাণ পানি দিন ভালো করে মিশিয়ে নিন। মিশানো মধুতে দুই তিন ফোটা ভিনেগার দিন। যদি আসল হয় তবে ফেনা হবে না কিন্তু নকল হলে ফেনা তৈরি হবে।
- যদি খাঁটি হয় তাহলে এটি দীর্ঘ দিন থাকার পরেও তলানিতে জমাট বাধবে না। তা ছাড়া খাঁটি মধুতে পিঁপড়া ধরবে না।
- আসল মধুতে তাপ দিলে তা দ্রুত কেরামেলের মতো হয়ে যাবে। এতে ফোমের মতো ফেনালি হবে না। কিন্তু নকল মধুতে তা হবে।
- খাঁটি মধুর স্বাদ হবে মিষ্টি এতে কোণও ঝাঁঝালো ভাব থাকবে না। কোণও কটু গন্ধ থাকবে না এর গন্ধ হবে মিষ্টি ও আকর্ষণীয়।
উপকারিতা
মধু তাপ শক্তির একটি ভালো উৎস। এটি দেহে তাপ ও শক্তি জুগিয়ে শরীরকে সুস্থ রাখে। এতে যে শর্করা থাকে তা সহজেই হজম হয়।
চলুন যেনে নেই এই মহৌষধিতে খওয়ার উপকারিতা :
- এতে রয়েছে চিনি যা শরীরে শক্তি যোগায় এবং শরীরকে কর্মক্ষম রাখে। যারা মিষ্টি পছন্দ করেন তারা নিয়মিত খাবেন এটা আপনার শরীরের জন্য উপকারি।
- প্রতিদিন পরিমাণ মতো মধু খেলে চোখের সমস্যা, পেটের সমস্যা, ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা কমে যায়।
- নিয়মিত খেলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। এর সাথে দারচিনির গুড়া মিশিয়ে খেলে রক্তনালীর সমস্যা দূর হয়।
- এর গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ক্যালসিয়াম। যেটি দাঁত, হাড়, চূলের গোড়া শক্ত রাখে এবং নখের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
- এতে রয়েছে ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স। যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ১ চা চামচ মধু সকালে গুম থেকে উঠে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হবে।
- ডায়রিয়া হলে এক লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার হানি মিশিয়ে খেলে পানিশূন্যতা দূর হবে।
- যারা হৃদরোগে ভুগছেন তাদের জন্য এটি খুবই উপকারি। কারণ এটি হৃৎপেশীকে সবল রাখে এবং এর কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
- মধু ফুসফুসের যাবতীয় রোগের জন্য উপকারি। যদি কারো অ্যাজমা থাকে তাহলে তারা মধু নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস টানবেন তাহেলে স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে পারবেন।
মধু ও কালোজিরা খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা
কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর করতে এক গ্লাস হালকা গরম পানিতে এক চামচ লেবু ও এক চামচ আদার রস মিশিয়ে খেলে আজীর্ণ রোগ কমে যায় এবং কোষ্ঠ কাঠিন্য সেরে যায়।
কাশি দূর করতে আদা, পাই, তুলসীর রসের সাথে মিশিয়ে দিনে দুই তিনবার খান কাশি কমে যাবে।
রক্তচাপ কমাতে এটি বেশ কার্যকরী। দুই চামচ মধুতে এক চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ও রাতেসেবন করলে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
খাওয়ার উপযুক্ত সময়
শরীরকে অসুখ বিসুখ থেকে রক্ষা করতে মধুতে আছে প্রচুর মিনারেল, ভিটামিন, ও এনাইজন। সঠিক সময়ে মধু খেলে রোগ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলবে। সকাল বেলা Honey খাওয়ার উপযুক্ত সময়। সকালে খালি পেটে হালকা গরম পানিতে লেবুর রস, মিসিয়ে খেলে তা ওজন কমাতে সাহায্য করে। অথবা সকালে লেবু আর কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে এই মহা-ঔষধ খাওয়া যেতে পারে।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, খাওয়ার উপযুক্ত সময়, এর উপকারিতা, খাঁটি হানি চেনার উপায়, রূপচর্চায় এর ব্যবহার নিয়ে আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। বাংলা ভাষায় টিপস ট্রিকস পড়তে নিয়মিত ভিজিট করুন আপনাদের প্রিয় টিপসওয়ালী ডট কম।