ড্রাগন ফল নিয়ে আমাদের অনেকেরই বেশ আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে যারা কিনা এখনও এই ফলটির স্বাদ গ্রহন করে নাই। প্রিয় ভিজিটর, আজকের লেখাজুড়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে ড্রাগন ফল কি, ফলের উৎপত্তি, কোথায় পাওয়া যায়, ড্রাগন ফলের উপকারিতা, দাম, চারা কোথায় পাওয়া যায়, ফল সংগ্রহ ও চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।
ড্রাগন ফল কি?
পিতায়য়া (Pitaya) বা ড্রাগন ফল (Dragon Fruit) হচ্ছে এক ধরনের ফণীমনসা বা ক্যাকটাস প্রজাতির ফল। এটি হোনোলুলু কুইন নামেও পরিচিত। মেক্সিকো, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা, উত্তর অ্যামেরিকায় ড্রাগন ফলের উৎপত্তি হলেও সুস্বাদু এই ফলটি বর্তমানে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া বিভিন্ন দেশ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ পৃথিবীর অনেক দেশে চাষ করা হয়। বিভিন্ন রঙের ড্রাগন ফলের মধ্যে লাল রঙের ড্রাগনফলই বেশি পাওয়া যায়।
ড্রাগন ফলের দাম
বাংলাদেশে সব এলাকায় ড্রাগন ফলের চাষ না হওয়ায় এর দাম তুলনামূলক একটু বেশি। বাংলাদেশের বাজারে ড্রাগন দলের দাম ৩৫০-৪৫০ টাকা। Dragon Fruit Price in Bangladesh is anywhere between 350(BDT) to 450(BDT).
প্রকারভেদ বা প্রজাতি
সাধারণত ৩ জাতের ড্রাগন ফল বা পিতায়য়া পাওয়া যায়। ১) লাল ড্রাগন ফল। এদের খোসা লাল রঙের হলেও শাঁস সাদা রঙের। ২) কোস্টারিকা ড্রাগন ফল। এই প্রজাতির খোসা ও শাঁস উভয়ই লাল রঙের হয়ে থাকে। ৩) হলুদ রঙের ড্রাগন ফল। খোসা দেখতে হলুদ হলেও এর ভেতরের আঁশ সাদা রঙের হয়ে থাকে।
ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুন
ড্রাগনের পুষ্টিগুন শুনলে আপনি অবাক হয়ে যেতে পারেন। মাত্র একটি ফলে রয়েছে ৬০ ক্যালরি। এছাড়াও এই ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমান ম্যাগনেসিয়াম, ওমেগা-৯, ভিটামিন সি, আয়রন, ওমেগা-৩, এবং বিটা ক্যারোটিন ও লাইকোপিনের মতো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট।
ড্রাগন ফলের ৫ টি উপকারিতা
ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুন জানার পর আপনার এই ফলের উপকারিতা সম্পর্কে একটু হলেও ধারনা চলে এসেছে। এই ফলে থাকা বিটা ক্যারোটিন আপনার শরীরে ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়ে চোখ, স্কিন ও ইমিউনিটি সিস্টেমের উন্নতি করে। কথা না বাড়িয়ে ড্রাগন ফলের আরও কি কি উপকারিতা রয়েছে সে সম্পর্কে জানা যাকঃ
১) হাড় গঠন ও হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি
হাড় গঠনে ম্যাগনেসিয়ামের গুরুত্ব আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে। এই ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমান প্রায় ১০% ম্যাগনেসিয়াম যা আপনার হাড়ের গঠন ও বৃদ্ধিতে বেশ ভাল ভুমিকা পালন করে থাকে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য এই ফল বিশেষ উপকারে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিদিন সঠিক নিয়মে এক বাটি ড্রাগন ফলে প্রায় ১৮% ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায়। হাড়ের বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ করে থাকে।
২) রক্ত সঞ্চালনের মাত্রায় ভারসাম্য
শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে রক্ত অন্যতম। আয়রন আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের ভূমিকা পালন করে। হিমোগ্লোবিন শরীরের টিস্যুতে অক্সিজেন পৌঁছে লোহিত রক্ত কনিকাকে সাহায্য করে। পাশাপাশি শরীরে আয়রনের মাত্রা হ্রাস পেলে আমাদের শরীরে নান সমস্যা দেখা দেয়। যদিও মাছ মাংস ডাল থেকে আমরা আয়রন গ্রহন করি তবে ড্রাগন ফলে রয়েছে প্রায় ৪% এর অধিক আয়রন। যা আমাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণে সক্ষম। একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি ২০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে প্রায় ২.১৮ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে। যা আমাদের শরীরের জন্য সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশেরও বেশি।
৩) ড্রাগন ফল কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ
অন্ত্রের বর্জ্য দূরীকরণের ফাইবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর একটি ফলে ৭ গ্রাম সমপরিমাণ ফাইবার রয়েছে যা আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ফাইবারের চার ভাগের একভাগ সমপরিমাণ। যা কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। আপনার যদি কোষ্ঠকাঠিন্য জনিত সমস্যা থাকে তবে ড্রাগন ফল হতে পারে আপনার জন্য একটি ভালো সমাধান। আপনি চাইলে ফ্রুত সালাদ কিংবা বেলেন্ডার এর সাহায্যে স্মুথি বানিয়ে সেবন করতে পারেন।
৪) চুল পড়া প্রতিরোধ
অল্প বয়সে চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যা আমাদের অনেকেরই রয়েছে। জিন গত সমস্যার কারনের অনেকের মাথার চুল অনেক অল্প বয়সে ঝরে যায়। আবার আয়রনের ঘাটতির কারনেও অনেকের মাথার চুল পড়ে যায়। ড্রাগন ফলে রয়েছে প্রচুর আয়রন যা আপনার চুল পড়া প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
৫) ইমিউনিটি সিস্টেম
আমরা সাধারণত ভিটামিন সি এর অভাবে নানা ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে পরি। ভিটামিন-সি আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেম শক্তিশালী করে তুলে। ড্রাগন ফলে থাকা ভিটামিন সি আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। এছাড়াও এই ফলে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট জা আমাদের শরীরের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এর মাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ড্রাগন ফল খাওয়ার নিয়ম
Pitaya বা ড্রাগন ফল খাওয়ার জন্য আপনাকে আলাদা কোন নিয়ম পালন করতে হয় না। এটি অন্যান্য সাধারন ফলের মতোই খাওয়া হয়। তবে এর আকার ও বাহিরের অংশ দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে এই ফল কিভাবে খেতে হয়। বিশেষ করে যারা আগে কখনও Dragon Fruit খায় নি। চলুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে ড্রাগন ফল খেতে হয়ঃ
- প্রথমে আনারসের মতো করে শিকড় বা গোঁড়ার দিক ও উপরের দিক অল্প করে কেটে নিন।
- ছুরি বা বটির সাহায্যে পরিমান মতো ছোলা বা সাল তুলে ফেলুন। আপনি চাইলে আস্ত অবস্থায়ও সাল বা ছোলা সরিয়ে নিতে পারেন।
- আপনার মতো করে সাইজ করে পরিবেশন করুন বা আকারে ছোট হলে হাতে নিতে খেয়ে ফেলতে পারেন।
- আপনি চাইলে ব্লেন্ডারের সাহায্যে জুস বানিয়ে খেয়ে ফেলতে পারেন।
ড্রাগন ফলের চাষ পদ্ধতি
কোন ফল বা সবজি চাষ করতে কিছু ধারাবাহিকতা পালন করতে হয়। নিচে ড্রাগন ফল চাষের পদ্ধতি ও নিয়ম দেওয়া হলোঃ
১) চাষের জমি নির্বাচন ও তৈরি
কোন কিছু চাষের পূর্বে চাষের জমি উপযুক্ত কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হয়। উর্বর-অনউর্বর কিংবা উচু-নিচু-সমতল এই সকল বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও মাটির ধরন যেমন- এঁটেল মাটি, দোআঁশ মাটি, বেলে মাটি এগুলোও বিবেচনা করতে হয়। কেননা সব মাটিতে সব ধরনের ফসল জন্মায় না। Dragon Fruit চাষের জন্য অবয়সি সু নিষ্কাশিত উচু ও মাঝারি উঁচু উর্বর মাটি বা জমি নির্বাচন করতে হবে। জমিতে ৩ থেকে ৩ টি চাষ দিয়ে ও চাষের পর ভালোভাবে মই দিয়ে মাটি সমান করে চারা রোপণ করতে হবে।
২) চারা সংগ্রহ
ড্রাগন ফলের চারা কোথায় পাওয়া যায়? এ নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। মূলত ড্রাগন ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে চারা উৎপাদনের চেয়ে এর কালম কাটিং থেকে নতুন গাছ জমানো বেশি ভালো। এতে সময় কম লাগার পাশাপাশি মাতৃ গুনাগুন বজায় থাকে।
৩) চারা রোপণের জন্য গর্ত
মই দেওয়া মাটিতে ১.৫ মিটার * ১.৫ প্রশস্ত * ১ মিটার আকারে গর্ত করে কয়েকদিন খোলা রাখুন যেন মাটি শুকিয়ে যায়। এর বিশ থেকে ১৫ দিন পর এক একটি গর্তে ২৫ থেকে ৩০ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম পরিমাণ টিএসপি ও এমওপি এবং ১৫ও গ্রাম জিপসাম ও ৫০ গ্রাম জিঙ্ক সালফেট মাটির গর্তের মধ্যে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিন। জায়গা যদি বেশি শুষ্ক হয় তবে পানি ছিটিয়ে দিন।
উপরের কাজ শেষ হয়ার ১২ থেকে ১৫ দিন পর এক একটি গর্তে ৫০ সেমি দূরত্ব বজায় রেখে প্রতি গর্তে ৪ টি করে চারা (কাটিং/কলম) সোজা ভাবে লাগান। নিয়মিত সেচ দিন। খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোঁড়ায় যেন বেশি পানিতে পচন না ধরে আবার শুকান না থাকে।
ড্রাগন ফলের চারা রোপণের এক মাস পর থেকে ১ বছর পর্যন্ত প্রতি তিন মাস পর পর ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার প্রয়োগ করুন। এতে চারা গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে ও বেশি ফলন আসবে।
৪) ড্রাগন ফল গাছের পরিচর্যা
গাছ লাগানোর সাথে সাথেই গাছে ফল আসে না কিংবা এমনি এমনি বেঁচে থাকবে না। এজন্য আপনাকে নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। যেভাবে ড্রাগন ফলের গাছের পরিচর্যা করবেনঃ
আগাছা গাছের জন্য খুবই ভয়ংকর এক নাম। ভালো ফলন পেতে নিয়মিত সেচ দেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত গাছের গোঁড়ার আগাছা পরিস্কার করতে হবে। গবাদি পশুর হাত থেকে বাঁচাতে বাগানের চারপাশে ভালো করে দুই থকে আড়াই মিটার উচ্চতায় বেড়া দিন।
মনে রাখবেন ড্রাগন গাছ লতানো হয় আর গাছ মাটিতে ছড়িয়ে পরলে আপনি সেখান থেকে ভালো ফলন পাবেন না কিংবা ফলে পচন ধরবে। আর এই জন্য আপনাকে চারার মাঝখানের দিকে ১ টি সিমেন্টের ৪ মিটার লম্বা খুঁটি পুতে দিতে হবে। চারা বর হওয়ার সাথে সাথে নারিকেলের বা খড়ের রশি দিয়ে খুঁটির সাথে বেধে দিতে হবে।
খুঁটির মাথায় মোটর সাইকেলের চাকার মতে গোলাকার কিছু একটা দিয়ে দিতে হবে। আপনি চাইলে সিমেন্ট দিয়ে খুঁটি বানানোর সময় এক সাথে বানিয়ে নিতে পারেন। এবং মোটা তারের সাথে আটকে দিন। গাছ বড় হলে গাছের মাথা বা ডগা টায়ারের ভিতরের দিক দিয়ে নিয়ে বাহিরের দিকে ঝুলিয়ে দিন। বিশেষজ্ঞদের মতে ঝুলন্ত ডগায় বেশি ফলন হয়।
৫) ড্রাগন ফল গাছের রোগ-বালাই ও দমনের উপায়
চাষিদের মতে ড্রাগন ফল গাছে তেমন একটা রোগ বালাই হয় না বললেই চলে। তবে এর মূলে পচন ধরে। মূলত গোঁড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে গেলে গাছের গোঁড়ায় পচন ধরে। আর এই সমস্যা থেকে বাচার একমাত্র উপায় হচ্ছে উঁচু জমিতে চাষ ও পানি নিষ্কাসনের ব্যবস্থা রাখা।
অনেক সম্য এফিড ও মিলি বাগের আক্রমন দেখা যায়। এফিড মূলত গাছের নরম ও কচি শাখা ও পাতার রস চুষে খায় এতে শাখা আক্রান্ত হয়ে ফ্যাঁকাসে হয়ে যায়। এবং গাছ দুর্বল হয়ে যায়। আবার এই পোকা গাছের উপরে মলত্যাগ করলে গুটিমোল্ড নামক ছত্রাক রগের দেখা দেয়। এতে গাছের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যহত হয়।
ছত্রাক থেকে বা গাছ ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলে এ থেকে মুক্তি পেতে প্রতি ১০ লিটার পরিমাণ পানিতে ২৫ মিলিলিটার ডেসিস বা ম্যালাথিয়ান কীটনাশক ছিটিয়ে দিন।
ড্রাগন ফল সংগ্রহের সঠিক সময়
মনে রাখতে হবে ড্রাগন ফলের চারা রোপণ করার এক থেকে দেড় বছর পরে ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল যখন সম্পূর্ণ লাল রঙ ধারন করে তখনই সংগ্রহ করতে হবে। ফুল ফোটার ৩০ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে যায়। এক বছরে আপনি ৫ থেকে ৬ বার ফল সংগ্রহ করতে পারবেন।
প্রিয় পাঠক, আশা করছি ড্রাগন ফ্রুটস নিয়ে আপনারা বিস্তারিত ধারনা পেয়ে গেছেন। এর এর পরেও আপনার কাছে কোন প্রশ্ন থাকলে কিংবা পরামর্শ থাকলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন আমাদের ফেসবুক পেজে।
আরও পড়ুনঃ জাফরান সম্পর্কে বিস্তারিত